৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের চেকপোস্টে কি কি ঘটেছিল, সে সব বেরিয়ে আসছে একের পর এক জবানবন্দি-বয়ানে। সেখানে সেদিন পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মেজর (অব) সিনহা মো. রাশেদ খান। এর এক মাসের মাথায় এসে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, পুলিশের তিন সোর্সকে দিয়ে সিনহাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ডাকাত নাটক সাজানোর নির্দেশ এসেছিল টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের কাছ থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী তার স্থানীয় সোর্সদের মাধ্যমে পাহাড় থেকে ডাকাত নেমে আসার নাটক সাজান। এরই অংশ হিসেবে মসজিদে মাইকিংসহ স্থানীয়দের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করে পুলিশের তিন সোর্স। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। কক্সবাজারের টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ের আশপাশের গ্রামে স্থানীয়দের মুখে মুখে এখন এই ‘ডাকাত নাটক’-এর গল্প।
এদিকে সিনহা হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে দুই নম্বর আসামি কারাবন্দি প্রদীপ কুমার দাশ এ পর্যন্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এ মামলায় এ পর্যন্ত ৮ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে লিয়াকত স্বীকার করেছেন, তার গুলিতেই সিনহা মারা যান। যখন গুলি করা হয় তখন সিনহার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। সিনহা অস্ত্র তাকও করেননি। অভিযুক্ত এপিবিএন
সদস্যরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, সিনহা গাড়িতে পিস্তল রেখে হাত উঁচু করে বের হন। এ সময় তিনি লিয়াকতকে শান্ত হতেও বলেন।
বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। তবে ঘটনার বর্ণনা দেখে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। অভিযুক্ত এপিবিএন সদস্যরাও বলেছেন, সিনহার গাড়ি চেকপোস্টে আসার আগে থেকে সেখানে অবস্থান করছিলেন লিয়াকত। এ সময় তাকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মনে হয়েছিল, তিনি যেন কারও অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। গুলি করার সময় তাকে খুবই হিং¯্র দেখাচ্ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বাসিন্দা ও সাক্ষীদের বয়ানে একটি বিষয় স্পষ্ট, পাহাড়ে সিনহার টিম কেন এসেছিল, তা জানা ছিল লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশের। ঘটনার কয়েক দিন আগে সোর্স ও স্থানীয়দের কাছে লিয়াকত ও ওসি খোঁজ নিয়েছিলেন, সিনহার দল পাহাড়ে কী করছেন।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, পুরো ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ এবং সোর্সদের বক্তব্য প্রমাণ করে যে, ঘটনার দিন সিনহা পাহাড় থেকে নামার পর ডাকাত সন্দেহে পুলিশের কাছে যে খবর দেওয়া হয়েছিল তা পরিকল্পিত। প্রদীপের সোর্সরা ওই সময় পাহাড়ে ছিল। তারাই ডাকাতির বিষয়টি মসজিদে ও স্থানীয়দের বলে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছে।
তিন আসামির জবানবন্দি
সিনহা হত্যা মামলায় গতকাল আরও তিন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি শেষে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত এই তিন সাক্ষী জ্যেষ্ঠ বিচারক তামান্না ফারাহর খাস কামরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ তিন আসামি হলেনÑ টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মো. আয়াছ। অবশ্য তারা তিনজন পুলিশের করা একটি মামলার সাক্ষী ছিলেন। এলাকায় তারা পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। পরে মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব তাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়ে গ্রেপ্তার করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার তিন সাক্ষীকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্র আদালতে তাদের হাজির করা হয়। ৪ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত দ্বিতীয় দফা ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডের প্রথম দিনই তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্বীকার করেন। এ জন্য আজ (গতকাল বুধবার) সাড়ে ১০টার দিকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। আশা করি আমাদের কাছে দেওয়া সব তথ্য আদালতের কাছেও তারা স্বীকার করেছে। দীর্ঘসময় ধরে আদালতে স্বীকারোক্তি শেষে তিনজনকে বিকালে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দেবে তদন্ত কমিটি
সিনহা হত্যামামলার আসামি টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার জেলা কারাগার ফটকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নযন) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তদন্ত দল। বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে চলে জিজ্ঞাসাবাদ।
পরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘসময় ধরে ওসি প্রদীপের সাথে কথা বলেছি। তার দেওয়া তথ্য এবং আগে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আমরা বিশ্লেষণ করছি। আশা করছি, সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা প্রতিবেদন দিতে পারব।
এর আগে ওসি প্রদীপকে সিনহা হত্যার তদন্ত সংস্থা র্যাব বিভিন্ন সময় ধারাবাহিকভাবে ১৫ দিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের কারণে ওসি প্রদীপের সাক্ষাৎ পাননি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত এ তদন্ত কমিটি। ফলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বারবার পিছিয়ে গেছে। সর্বশেষ ৩১ আগস্ট তৃতীয়বারের মতো সময়ের আবেদন করে তদন্ত কমিটি।
সিনহা হত্যাকা-ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান সেনাপ্রধান
সেনাবাহিনীর আর কোনো সদস্যকে যেন সিনহার মতো ভাগ্যবরণ করতে না হয়, সে জন্য তার হত্যাকা-ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করেছেন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা ক্রিমিনাল, তাদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা সেনাবাহিনীতে কর্মরত বা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কারও সঙ্গে না ঘটে। আমি সেটা প্রত্যাশা করি।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ কা-ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। অন্যদিকে প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীসহ ৯ জনকে আসামি করে সিনহার বোন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরদিন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন প্রদীপসহ সাত আসামি।
Leave a Reply